তপন মাহমুদ
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০১৭ শনিবার, ০৮:৩৬ এএম
বিচিত্র এই দেশ। বিচিত্র এই দেশের কাণ্ড-কারখানা। সব সময়ই আমাদের আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি কিছু হলো। কে কিভাবে কখন কোথায় ‘ফেঁসে’ যাই বোঝা সত্যিই মুশকিল। কেমন যেন একটা অদ্ভূত সময় পার করছি আমরা! চারদিকে ফাঁপা গণতন্ত্র আর চাপা ক্ষোভ। ভালো থেকেও যেন কোথাও কিছু একটা নেই।
এই ‘নয়া টেকনো যুগে’ আমাদের অনেক কিছুই আর টেকানো যাচ্ছে না। প্রাইভেসি এখন ফেসবুকের ওয়ালে বাসা বেঁধেছে। পাঠ্যবই আর গল্পের বইয়ের চেয়ে ফেসবুকেরই এখন বেশি কাটতি। কথায় কথায় স্ট্যাটাস আর সেলফি। লাইক শেয়ারেই এখন মাপজোখ হচ্ছে সম্পর্কের।
জীবনটা একেবারে বদলে দিয়েছেন মার্ক জুকারবার্গ। তবে, শুধু মানব জীবনই না, গণমাধ্যমের চরিত্র পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছেন। সবাইকে লাইক শেয়ারের কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি। আর এগুলো পেতে কত কিছুই না করতে হচ্ছে।
চলতি মাসেরই ১৬ তারিখ রাতে আমার এক বন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে আমারই চোখ ছানাবড়া। তিনি লিখেছেন, ‘ ঘৃনায় জিভ তেতো হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে গালাগাল করতে ইচ্ছে করছে’ তখন ভাবলাম কোন দেশে বাস করছি আমরা? যে গণমাধ্যমের কাজ মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, তারাই কিনা মানুষের মর্যাদা নষ্ট করছে? শুধুমাত্র কাটতির জন্য? হোক না অখ্যাত কোনও অনলাইন?
ওই অনলাইন বনানীতে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত নাইম আশরাফকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে। তারা শিরোনাম করেছে ‘ধর্ষক নাইম আশরাফের বেপরোয়া জীবন ( এক্সক্লুসিভ ছবিসহ)। ’ তারা তো বিচারের আগে ‘ধর্ষক’ বলতেই পারেন না, সেটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু কি এক্সক্লুসিভ ছবি দিয়েছেন তারা? ফেসবুক থেকে নেওয়া কয়েকটা সেলফি। তাতে অনেকের সাথে আমার ওই বন্ধুটিরও একটি সেলফি ছিল। সেলফিটি একটি রেস্টুরেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তোলা হয়েছে।
আমি অনলাইনের সংবাদটি পড়ে দেখেছি। এরকম নিম্ন মানের (অ)সংবাদ কিভাবে ছাড়া হয় আমি জানি না। এরা কার কাছে দায়বদ্ধ তাও আমি জানি না। আর হাতের কাছে যে ছবি পেল আর তাকে অপব্যবহার করলো, এই জবাবও আমরা কার কাছে চাইবো? তারা কি একটিবারও ভাবলো না, সেলফির অন্য মানুষগুলোর এতে মানহানি হবে। তাদের নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা তৈরি হবে? এটা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরোধী?
একটি অনলাইন সংবাদ করেছে, ‘সেলিব্রেটিদের সাথে ছবি তোলা ছিল ‘ধর্ষক’ নাইমের কৌশল’। এই সংবাদের আগা মাথা নীতি নৈতিকতা কিছুই বুঝলাম না। কিসের কৌশল, কেন কৌশল কিছুই লেখা হয়নি সংবাদে। নাইম কি জানতেন সে একদিন ধর্ষণ করবে? আর এই ছবিগুলো তার কী কাজে লাগবে?
এই অনলাইনটি আবার সংবাদ করেছে ‘ফারহানা নিশো একুশে টিভি থেকে বরখাস্ত’। খবরে বলা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে সেলফির কারণেই তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছাড়া কিভাবে এরকম একটা সংবাদ করতে পারে? তাদের তো জানা উচিত ধর্ষকের সাথে ছবি যে কারোই থাকতে পারে। সেখানে তাদের দোষ কোথায়? এই দায়বদ্ধতাহীন অসংবাদিকতার শেষ কোথায়?
দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমের এসব বিষয় নিয়ে, সাংবাদিকতার এই চর্চা নিয়ে কথা বলা জরুরি। কারণ এর মাধ্যমে পুরো সাংবাদিকতা শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মনে রাখবেন, বালা আসলে পীরের গায়েও লাগে। আর আমাদের দেশে প্রেস কাউন্সিল বলে একটা জায়গা আছে না? তার কাজ কি, কেউ বলতে পারবেন? জনগণের টাকায়ই তো তাদের বেতন হয় তাই না?
একই কাণ্ড আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও দেখলাম। ধর্ষণের অভিযুক্ত নাঈম আশরাফের সাথে সেলফি বা ছবি, বিশেষ করে নারীদের, অনেকেই শেযার করেছেন। এইসব লোকজনের কাছে আমার প্রশ্ন, এ জীবনে আপনি তো অনেক মানুষের সাথে সেলফি তুলেছেন। তাদের কেউ কখনও যদি ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তখন সেই ছবির কী হবে?
মূল ঘটনায় না থেকে, ঘটনার মূলে না গিয়ে, শাখা প্রশাখায় হাঁটার অভ্যাসটা মনে হয় পুরনো। আমরা ধর্ষক শাফাতের ধর্ষণের চেয়ে তার বাবার বা পরিবারের স্বর্ণব্যবসা নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি, নাঈম আশরাফের ধর্ষণের বিচার চাওয়ার চেয়ে তার সেলফি নিয়ে বেশি গালগল্প করছি।
আমরা কিছু মানুষকে সেলফির ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেরাই যে ভয়ঙ্কর চোরবালিতে আটকে পড়ছি, সেটা হয়তো বুঝতেই পারছি না। আমরা কী অনুশীলন করছি? আমরা কী শেখাচ্ছি তরুণ প্রজন্মকে? ন্যায়ের পক্ষে বলতে গিয়ে আমরাই যদি অন্যায় করে ফেলি, তাহলে তো একটা সময় আমাদের মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না।